অথোই (2024) সম্পূর্ণ গল্প | হৃদয়ভাঙা ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মধ্বংস...

ভিনসুরার রুক্ষ, মাটির গন্ধমাখা বাতাসে ছোট্ট অথোই প্রথম শ্বাস নিয়েছিল এক শীতের সকালে। তার মা, এক দলিত বিধবা নারী, সমাজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যুদ্ধ করতেন—সম্মানের জন্য, পেটের ভাতের জন্য, আর তার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য। অথোই ছোট থেকেই বোঝে—জন্ম এক জিনিস, কিন্তু মানুষ হওয়া আরেক জিনিস। মানুষের চোখে সে কখনো “মানুষ” হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ তার গায়ের রঙ একটু কালো, তার নামের পাশে একটা "নিম্ন" পরিচয়। তবে তার মা তাকে বলতেন—“পড়াশোনা কর, ভালো মানুষ হবি, তখন কেউ তোর গায়ে কিছু বলতে পারবে না।”

কিন্তু সেই পথ সহজ ছিল না। গ্রামের স্কুলে উচ্চবর্ণ ছেলেরা তাকে ছুঁতে চাইত না, খেলতে নিত না। অথোই কাঁদত না। সে মুখ গুঁজে পড়ত—পাঠ্য বইয়ের পাতার মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে নিত, মুক্তি খুঁজত।

একদিন তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। খাবার না পাওয়ায় শরীর ভেঙে যায়, আর চিকিৎসা তো ওদের জন্য বিলাসিতা। সেই রাতেই তাঁর মৃত্যু হয় অথোইর কোলে। অথোইর ১০ বছর বয়স তখন। বুক ফাটে, চোখে জল নেই। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সে শপথ করে—“আমি ডাক্তার হবো, আমি কারো মাকে মরতে দেবো না।”

গ্রামের জমিদার তখন তাকে ডেকে নেন নিজের বাড়িতে, দয়া দেখিয়ে নয়—পিতৃস্নেহহীন গোগোর জন্য বন্ধুর খোঁজে। গোগো আর অথোই বড় হতে থাকে একসঙ্গে। খেলাধুলা, পড়াশোনা, সব কিছুতেই অথোই এগিয়ে থাকে। গোগো হাসে, বাহবা দেয়, কিন্তু সে হাসির পেছনে ক্রমে জমতে থাকে এক অদ্ভুত অন্ধকার—যাকে বলে ঈর্ষা। অথোইকে সে "আপন" বলে মেনে নেয় না, বরং এক চেপে রাখা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করে।

অথোই বড় হয়ে কলকাতায় যায়। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। ক্লাসে প্রথম, সিনিয়রদের প্রিয়, রোগীদের আশার আলো হয়ে ওঠে সে। তখনই তার জীবনে আসে দিয়া—কলকাতার এক নামী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। দিয়া দেখেছিল অথোইর চোখে মমতা, আত্মবিশ্বাস, আর একধরনের বেদনা যা তাকে ছুঁয়ে যায়। প্রেমে পড়ে তারা। দিয়া সমাজ, পরিবার, জাতপাত—সবকিছু উপেক্ষা করে অথোইকে বিয়ে করে। অথোইর কাছে দিয়া শুধু স্ত্রী নয়, এক নতুন জীবনের প্রতীক, যেখানে ভালবাসা জয়ী হয় ঘৃণার উপর।

কিন্তু সুখের সে গল্পে ছায়া ফিরে আসে—গোগো। বিদেশ ফেরত, আড়মোড়া ভাঙা এক পুরনো ঈর্ষার আগুন নিয়ে সে ঢুকে পড়ে অথোইর শান্ত সংসারে। সে দেখে, অথোই এখনও সবার প্রিয়—এখন তার কাছে টাকা আছে, সম্মান আছে, আর এমনকি দিয়া নামের অপূর্ব এক স্ত্রীও। গোগোর ভেতরটা জ্বলে ওঠে। ঠাণ্ডা মাথায় সে খেলতে শুরু করে এক বিষাক্ত খেলা।

তাকে বিশ্বাস করে অথোই। ছোটবেলার বন্ধু, ভাইয়ের মতো। অথোইর সন্দেহ হয়নি—যে মানুষ তার সঙ্গে ভাত খেয়েছে, সে-ই তার সর্বনাশ করবে। গোগো বলত, “দেখ, দিয়া আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসত, তোকে তো সে করুণা করে বিয়ে করেছে।”
“আমি তো চাই না কিছু খারাপ হোক… কিন্তু তোকে জানানোটা দরকার ছিল।”
এমন ছলাকলা, নাটকীয়তা—যা অথোইর স্নায়ুর ভিতর ঢুকে পড়ে এক বিষাক্ত ফোঁড়ার মতো।

অথোই বুঝে উঠতে পারে না—যে মানুষ একদিন তার দুঃখের সাথী ছিল, সেই দিয়া, সে কি সত্যিই প্রতারণা করছে? প্রশ্ন করতে পারে না, শুধু চিন্তা করে। দিয়া বারবার ভালবাসা দেখায়, অথোই তবু চোখে দেখতে পায় সন্দেহ। প্রেম তখন রূপ নিতে থাকে বিষে। অথোই একদিন গোগোর সাজানো "প্রমাণ" দেখে আর নিজেকে থামাতে পারে না। সে রাত, যেন সময় থেমে যায়। অথোই নিজের হাতে দেয় ওড়না, নিজের স্ত্রীর গলায়, আর মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায় এক স্বপ্নের জীবন।

তখনই গোগো মুখ খোলে। যেন একজন শিল্পী তার আঁকা চিত্র শেষ করে গর্বের সঙ্গে তা প্রকাশ করে—গোগো বলে, “তুই আর আমি এখন সমান। আমি তোদের কাউকে সুখী হতে দিলাম না।”

অথোই বসে থাকে, স্তব্ধ, স্ত্রীর নিথর দেহের পাশে। চোখ ফেটে কান্না আসে না। পৃথিবী যেন অর্থহীন। সে জানে, এই বোঝা বয়ে সে বাঁচতে পারবে না।

পরদিন সকালে, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে লাশ পড়ে থাকে অথোইর—হাতের মুঠোয় একটা চিরকুট, সেখানে লেখা—“আমার ভুল ছিল বিশ্বাস নয়, অবিশ্বাসে। দয়া করে আমার মৃত্যুকে শিক্ষা করো, প্রতিশোধ নয়।”

এ গল্প বলে দেয়—সবচেয়ে বড় শত্রু বাইরে নয়, অনেক সময় সে বসে থাকে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মুখোশের আড়ালে।

আর কখনো কখনো, সত্য জেনে ওঠার আগেই জীবন শেষ হয়ে যায়।

Comments

Popular posts from this blog

CCL Digital Set Top Box

Alita: Battle Angel (2019) 375MB 480P WEB-DL Dual Audio [Hindi-English]