হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণে যিনি আমাদের জীবনের সাধারণ গল্পগুলোকে পরিণত করেছিলেন রুপালি পর্দার কবিতায়
হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণে
যিনি আমাদের জীবনের সাধারণ গল্পগুলোকে পরিণত করেছিলেন রুপালি পর্দার কবিতায়। অনেকে বলেন, তেরো সংখ্যাটি অশুভ। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৩ নভেম্বর হয়ে উঠেছে আশীর্বাদের দিন—এই দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন সেই মানুষটি, যিনি গল্পে, সিনেমায় আর অনুভূতিতে বাঙালিকে নতুনভাবে চিনতে শিখিয়েছিলেন—হুমায়ূন আহমেদ।
উপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা—তিন ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর সিনেমায় ছিল না কৃত্রিমতা বা বাড়াবাড়ি নাটকীয়তা। ছিল আমাদের ঘর, আমাদের হাসি, আমাদের অশ্রু, আর জীবনের সহজ সত্য। টিনের চালের নিচে ছোট ছোট সুখদুঃখকে তিনি পর্দায় এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের জীবন দেখতে পাচ্ছি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। পিতা পাকিস্তান বাহিনীর হাতে শহীদ হন, আর ২৩ বছরের এক তরুণ হুমায়ূন তখন দেখেছিলেন যুদ্ধের নির্মমতা। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর অনন্য সৃষ্টি আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)। এক সাধারণ পরিবারের আশ্রয়ে থাকা আহত মুক্তিযোদ্ধা বদি—এই চরিত্রের ভেতর দিয়েই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের যুদ্ধে জড়ানো ভালোবাসা, ভয়, আর অমানবিক সময়ের মানবিক মুহূর্তগুলো।
এরপর চন্দ্রকথা (২০০৩)-তে তিনি ফিরে যান লোকজ জীবনের রঙে, যেখানে বাস্তব আর কল্পনা একসাথে বয়ে চলে। গ্রামের উঠোন, লোকসঙ্গীত, আড্ডা—সব মিলিয়ে তিনি এঁকেছেন বাংলাদেশের মাটির গন্ধমাখা জীবন।
শ্যামল ছায়া (২০০৪)-তে তিনি আবারও ফিরে যান ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপটে—তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, পালিয়ে বাঁচার এক যাত্রায়। নৌকায় ভেসে থাকা মানুষের দল হয়ে ওঠে ক্ষুদ্র এক বাংলাদেশ—ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলমান, সাহসী-ভীত—সবাই একসাথে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এই নৌকাই যেন মানবতার প্রতীক, যেখানে ধর্ম নয়, মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
আমার আছে জল (২০০৮)-এ হুমায়ূন আহমেদ ফিরে আসেন অনুভূতির সূক্ষ্মতায়। এখানে নেই উচ্চারণ, আছে নীরবতার গভীরতা। চোখের চাহনি, না-বলা কথা, আর বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ওঠে সম্পর্কের ভাষা।
সবশেষে আসে তাঁর সাহসীতম কাজ ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)। হারিয়ে যাওয়া ঘেটু গানশিল্পীদের জীবন নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে শিল্প, শোষণ আর নিষ্ঠুরতার মাঝে জড়িয়ে যায়। একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে মানবতার আর্তি—দুটি মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে হুমায়ূনের শেষ এবং শ্রেষ্ঠ আত্মপ্রকাশ।
হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা আমাদের নদীর মতো—স্বাভাবিক, শান্ত, অথচ গভীর। তাঁর চরিত্রগুলো আমাদেরই প্রতিবেশী, আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি শিখিয়েছেন—সাধারণ জীবনই সবচেয়ে অসাধারণ, যদি তা ভালোবাসা দিয়ে দেখা যায়।
তেরো সংখ্যার জন্মদিন হয়তো কুসংস্কারীদের কাছে অশুভ, কিন্তু সেই দিনেই জন্ম নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রমাণ করেছেন—ভাগ্য নয়, মানুষই নিজের সৌভাগ্য তৈরি করে। তাঁর সিনেমায় আমরা দেখেছি নিজেদের মুখ, নিজেদের গল্প। আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা স্মরণ করি সেই মানুষটিকে, যিনি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছেন চিরকাল।
#হুমায়ূনআহমেদ #বাংলাদেশেরগর্ব #বাংলাচলচ্চিত্র #স্মরণে_হুমায়ূন

Comments
Post a Comment